কেমন ছিল ময়ূর সিংহাসন?

 

সৌখিনতায় মানুষ কি না করে থাকে,কথায় আছে শখের তোলা নাকি আশি! ইতিহাসে মোঘল সম্রাজ্যের শাসন এক বিশাল অধ্যায়, শখের ক্ষেত্রে তারা ছিলো অন্যসব সম্রাজ্য থেকে ভিন্ন এক কথায় ভারতীয় ইতিহাসের স্থাপত্য শিল্পের আলোচনা তাদের দখলেবিশেষ করে নির্মাণ শৈলীতে ভারতীয় প্রাচীন সকল নির্মাণ শৈলী তাদের হাতে গড়া এদের মধ্যে একটি হচ্ছে ময়ূর সিংহাসন

আজকের আয়োজন সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন আর এ নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন-

আবদুল্লাহ আল মেহেদী   


ময়ূর সিংহাসন হাতছাড়া হয়ে যায় মোঘলদের কাছ থেকে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণের সময় সাথে নিয়ে করে নিয়ে যান মহা মূল্যবান এই সিংহাসন মূলত মোঘলদের দুর্বলতাই দায়ী এই অসাধারণ নির্মাণ শৈলীটি হারানোর জন্য এমন ধারণা করা হয়ে থাকে আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটিকে বিকৃত করা হয়েছে



ইতিহাসে নান্দনিক নির্মাণ শৈলীর অনন্য উদহারণ ময়ূর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহান এই সিংহাসন নির্মাণ করেন শৌখিনতায় সম্রাট শাহজাহান ছিলেন এক অসাধারণ তিনি যে  রুচিশীল ছিলেন তা বুঝা যায় তার কিছু নির্মাণ শৈলীতে সম্রাট বাবরের সিংহাসন ছিল শ্বেতপাথরের তৈরি আকবরের সিংহাসন ছিল লাল পাথরের উঁচু সিংহাসন জাহাঙ্গীর ব্যবহার করেন কালো পাথরের সিংহাসন

ক্ষমতায় এসে শাহজাহান সব ছাড়িয়ে নতুন এক সিদ্ধান্ত নেন তিনি ভিন্ন রকমের এক সিংহাসনের তৈরির আদেশ দেন

কিছু স্থাপত্য আজো টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েতাজমহল তাদের মধ্যে অন্যতম এ ছাড়াও আগ্রার দুর্গ, মতি মহল, লাল কেল্লা, মতি মসজিদ, রঙ্গ মহল, হীরা মহল ইত্যাদি তার অনবদ্য সৃষ্টি মতি মসজিদ নিয়ে একটি কথা আছে ইতিহাসে, মতি মসজিদে মিম্বরের ঠিক উপরে মিনারে তিনি এমন একটি আলোর ব্যবস্থা করেন যা সাত মাইল দূর থেকেও আলোর বিচ্ছুরণ দেখা দিতো! তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে মাত্র একটি মোমবাতি ব্যবহার করা হতো এই আলোর জন্যপুরো মসজিদ আলোকিত একটি মোমের মাধ্যমেই     

শখের ময়ূর সিংহাসনটি বানিয়েছিলেন বেশ কারুকার্য ও নন্দন শৈলীতে বর্তমানে এটি না থাকলেও ইতিহাসে নাম করে নিয়েছে ঠিকই ময়ূর সিংহাসন নামকরণ করা হয়েছে পিছনে দুটি ময়ূরের আকৃতির জন্য দেখে মনে হতো  পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে ময়ূর দুটি তাই এটি ময়ূর সিংহাসন নামেই পরিচিতি লাভ করে   



নানারকম দুষ্পাপ্য আর মূল্যবান  রত্ন পাথর দিয়ে পেখমগুলো খচিত ছিল সম্রাট শাহজাহান এমন সব রত্ন পাথর সংগ্রহ করেছিলেন যা দুনিয়া জুড়ে দ্বিতীয়টি পাওয়া যায়নি এদের মধ্যে কোহিনূর একটি  পৃথিবীতে মাত্র দুটি কোহিনূর পাথর ছিল যার দুটিই ছিল শাহজাহানের দখলে

সিংহাসনে ব্যবহার করা পাথরের মধ্যে ছিল নীলকান্ত মণি, পান্না, চুন্নি,পদ্মরাগ মণিসহ মূল্যবান নানান পাথর এগুলি কিনতে ব্যয় হয়েছিল ৮৬ লাখ রোপ্য মুদ্রা  শুধু বসার জন্য যে স্থানটি তৈরি করা হয় সেটার ব্যয় হয়েছিল দশ লাখ রোপ্য মুদ্রা   

মুগ্ধময় এই সিংহাসন দেখতে ছিল অনেকটা বিছানার মতো! দৈর্ঘ্য ৩ গজ আর প্রস্থে আড়াই গজ উচ্চতায় ছিল সাত গজ ১২টি পিলার এই বিশাল সিংহাসনটিকে শামিয়ানাসহ ঘিরে রাখতো ৩২ কেজি গিনি সোনা ব্যবহার করা হয় এই সিংহাসনে

ময়ূর সিংহাসন তৈরিতে সময় লেগেছিল ৮ বছর, নির্মাণ ব্যয় ছিল ৮ কোটি টাকা!  তাজমহলের বানাতেও এতো টাকা লাগেনি সেই আমলের ৮ কোটি টাকা এখন ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান! ওজনে সাড়ে পাঁচ মণ ছিল এই সিংহাসনটি

সাত বছরের নির্মাণ সময়ে তিনি একবারের জন্যও এই আসনে বসেননি, আট বছরের মাথায় তিনি এই আসন গ্রহণ করেন আসনে এমন সাতটি হীরা স্থাপন করেন যা ছিল তার শাসনের সাতটি বছরের প্রতিক সবচেয়ে বড় যে হীরাটি ছিল তার ওজন ১৫৭.৪ গ্রাম সবগুলিই ছিল মহামুল্যবান বলা হয়ে থাকে এই সিংহাসনটির বাজার মুল্য তৎকালীন সারা দুনিয়ার একদিনের খাবারের খরচেরও বেশি    

২৩ গ্রাম ওজনের একটি দুর্লভ হীরা সংগ্রহ করেছিলেন সম্রাট আকবর শাহজাহান সেই হীরাটি সিংহাসনে ব্যবহার করেন  এছাড়া সামারি রুবি নামে ৫৪ গ্রামের একটি হীরা ছিল যা পৃথিবীতে আর নেই বলে ধারণা করা হয় সিরাজ ই আলম নামে একটি ৭২ গ্রামের হীরা তিনি তার সিংহাসনে ব্যবহার করেন     

ময়ূরগুলি বসানো হয়েছিল মুখোমুখি করে, দেখে মনে হয় দুটো ময়ূর গাছ থেকে ফল খাচ্ছে সিংহাসনে উঠা নামার জন্য তিনটি নজরকাড়া সিঁড়ি ব্যবহার করা হতো ময়ূরের লেজ ছিল  নীল রঙের মণি দিয়ে তৈরি বুকে ছিল বড় ধরণের চুন্নি ৫০ ক্যারটের একটি হলুদ রঙের মুক্তা ময়ূরের গলায় ঝুলে থাকতো    

১৬৩৫ সালের মার্চ মাসের ২২ তারিখ এক বিশেষ স্মরণীয় দিন ভারতবর্ষের জন্য, ঈদুল ফিতরের দিন বাদশাহ শাহজাহান আসন গ্রহণ করেন নতুন সিংহাসনে প্রায় ১০৪ বছর টিকে ছিল এই মহামুল্যবান সিংহাসন



১৭৩৯ থেকে থেকে সম্রাট শাহজাহানের শাসন আমলের পরও এই ময়ূর সিংহাসন টিকে ছিল একদিন হারিয়ে যায় বিশ্বখ্যাত এই সিংহাসন শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোঘল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দূর্বল হতে থাকে  শাসনভার ধরে রাখতে পারেননি মোঘলরা

১৭৩৯ সালের কথা দুর্বল মোঘল সম্রাজ্যে পারস্যের নাদির শাহ আক্রমণ করেন লুণ্ঠন করেন অনেক কিছু সাথে নিয়ে যান এই ময়ূর সিংহাসনও সম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন মোহাম্মদ শাহ

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নাদির শাহ অনুরূপ আরেকটি ময়ূর সিংহাসন নির্মাণ করেছিলেন কোহিনূর পাথরকে নাদির শাহ বেশ যত্নে রেখেছিলেন পরবর্তীতে তিনি এই ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর নিয়ে খুন হন মূল্যবান এই দুটি জিনিস পারস্যে আর নেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে ঐতিহাসিকদের মতে কোহিনূর পাথরকে অপয়া মনে করা হতো   

তবে ময়ূর সিংহাসন হারিয়ে যাওয়া খুব রহস্যময়! ধারণা করা হয়, সিংহাসনটি হয়তো ওসমানী সম্রাজ্যের সুলতানদের দেওয়া হয়েছিল আবার বলা হয়ে থাকে এটির একটি অংশ তুর্কির ইস্তাম্বুলে যাদুঘরে সংরক্ষণ আছে  

এই সিংহাসন নিয়ে মজার একটি তথ্য আছে, এই আসনে বসলেই মনে হতো ময়ূর দুটি পেখম মেলে নাচছে 

কিন্তু কোথায় হারালো এই অমুল্য সম্পদ? আজো কি টিকে আছে? লোকচক্ষুর আড়ালে টিকে আছে নাকি টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে অমূল্য সিংহাসনটি? এই মুল্যবান সিংহাসনটি ক্রমান্বয়য়ে হাত বদল হয় ইতিহাসবিদের ধারণা, ময়ূর সিংহাসনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে



কারো কারো মতে, ১৭৪৭ সালে ব্রিটিশরা এটি চুরি করে নৌপথে নিয়ে যাবার সময় জাহাজ ডুবিতে হারিয়ে যায় পরে আবার বিশ্বে প্রচার করা হয় ময়ূর সিংহাসনের কিছু অংশ পাওয়া গেছে তবে এসব তথ্যের মধ্যেই বেশ গড়মিল দেখা যায়

ফলে ময়ূর সিংহাসনের শেষ কী হয়েছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কোন সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা যাচ্ছে না তবে সিংহাসনে থাকা মূল্যবান কোহিনূর পাথর হাত বদলে বর্তমান ইংল্যান্ডে রাণীর মুকুট স্থান পেয়েছে কোহিনূর 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ষাট বছর বয়সে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেয়া অ্যানি এডসন টেলর

মহামারী প্লেগ, পলিও আর ভয়ানক পীত জ্বরের কথা