মহামারী প্লেগ, পলিও আর ভয়ানক পীত জ্বরের কথা

 

প্লেগ

বিউবনিক প্লেগ’ বা ব্ল্যাক ডেথ নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী। যার কবলে ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ইতিহাসের এক ভয়ানক সময় বলা যায় সেই সময়কে। সে সময়ে মানুষ একে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে মনে করতো।

সম্প্রতিকালে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কোনো রেকর্ড নেই। ১৯৯৪ সালে ভারতে দু'বার প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার বিস্তার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল ব্যাকটেরিয়ার বাহক ফ্লি উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইঁদুর মেরে এবং প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে তাদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ ও অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে।

ব্যাকটেরিয়াঘটিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি এই প্লেগ। ইতিহাস সূত্রে ও লোকমুখে জানা যায় মধ্য যুগে বহু রাজ্য এ রোগ দ্বারা ধ্বংসাত্মক পরিণতির শিকার হয়েছে। একজন নিউমোনিক প্লেগে সংক্রমিত মানুষ অন্য মানুষে রোগ ছড়ায় এবং এভাবে প্লেগ মহামারীর আকার পায়। সঠিক হিসাব না থাকায় অনুমান করা হয় যে, চর্তুদশ  শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা অর্থ্যাৎ প্রায় ২৫,০০০,০০০ মানুষ প্লেগে আকান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলো। ব্ল্যাক ডেথের রেখে যাওয়া গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় পরবর্তী বেশ কয়েক প্রজন্মের। তবে কিছু কিছু উৎসে ১০ কোটিতেও ঠেকেছে সংখ্যাটা।

রোগের সিমটম বা প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে, প্রথমে কব্জি বা বগলে টিউমারের মতো কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে। ধীরে ধীরে সেটি বড় হতে থাকে। এক পর্যায়ে ডিমের আকৃতি ধারণ করে ও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কালো রঙ্গের এই ফোঁড়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এক পর্যায়ে এগুলো পচে যায় ও পুঁজ বের হতে থাকে ! তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে মৃত্যু!

প্লেগকে ইতিহাসের ভয়ঙ্কর মহামারী বলে বিবেচনা করা হয়। ১৩৪৭-৫১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালই ছিলো ব্ল্যাক ডেথের বিধ্বংসী সময়। এ সময় ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণবায়ু কেড়ে নেয় এই মহামারী। তবে এই অভিশপ্ত মহামারীর প্রভাব টিকে ছিলো অন্তত ২০০ বছর। বেশির ভাগ গবেষক দাবি করেছেন, এই মহামারী চীন থেকে শুরু হয়েছিলো। চীনে এই রোগ কীভাবে শুরু হয় তা আজো একটি রহস্য। 

 


কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, মহামারীর চূড়ান্ত পর্যায়ে সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার মানুষ মারা যেতো! তবে এটা লোকমুখের কথা।

প্লেগ ইউরোপে পৌঁছে যায়। রোগের প্রধান জীবাণুবাহী হচ্ছে ইঁদুর। প্লেগের জীবাণু  কালো ইঁদুরের সঙ্গে ১৩৪৬ সালে চীনের ইউক্রেন ক্রিমিয়ায় পৌঁছে। ক্রিমিয়া থেকে যখন জিনিস ভর্তি জাহাজকে ইতালি উদ্দেশ্যে ছাড়া হয় তখনই প্লেগের জীবাণু ইঁদুরের মাধ্যমে জাহাজে চলে আসে। সে সময় প্লেগের ফলে ইউরোপের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। মানুষ মানতে শুরু করেন, ঈশ্বর মানুষের ওপর বেজার হয়েছেন আর এজন্যই এমনটা হচ্ছে।

এক সময় অনেকেই বিশ্বাস করতো যে, সিন্ধু নদীর পূর্বাঞ্চলে প্লেগ কখনো দেখা    দেয় না। কিন্তু উনিশ শতকে ভারতের একাধিক জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে! সে সময়ে দুর্ভিক্ষও ছিলো। তিন বছর প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের পর ১৮১৫ সালে  গুজরাট, কাথিওয়ার এবং কুচ এলাকায় প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়।

পরের বছরের শুরুতেই ঐ এলাকাগুলিতে এ রোগ আবার আঘাত হানে এবং ক্রমে তা সিন্ধু প্রদেশ ও হায়দ্রাবাদসহ দক্ষিণ-পূর্বে আহমাদাবাদ ও ধলেরা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

 ১৮২০ সালে অথবা ১৮২১ সালের প্রথমভাগে এ রোগ তিরোহিত হয় এবং ১৮৩৬ সালের জুলাই পর্যন্ত আর দেখা যায় নি। আবার ১৮৩৬ সালের শেষভাগে রাজপুতনার পালি শহরে প্লেগ দেখা দেয়। ক্রমে পালি থেকে আজমীর-মারওয়ারাতে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৩৭ সালের গ্রীষ্মকালে ঐ এলাকা থেকে প্লেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৮৪৯, ১৮৫০ এবং ১৮৫২ সালে এ রোগ আবার মারাত্মকভাবে দেখা দেয় এবং দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে। ১৮৭৬-৭৭ সালের প্রাদুর্ভাব এমন মারাত্মকভাবে দেখা দেয় যে ভারতীয়রা এ রোগকে মাহামারী নামে আখ্যায়িত করে।

নাম করণটা হয় মূলত, ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে এই  রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল বিধায় একে ব্ল্যাক ডেথ বলা হয়।

 

 

পীতজ্বর

পীতজ্বরও একটি মহামারী রোগ হিসেবে ইতিহাসে ঠাই করে নিয়েছে।  অন্য নাম  ইয়েলো ফিভার। এটি ভাইরাসঘটিত রোগ। রোগের লক্ষণসমূহ- জ্বর, ক্ষুধামন্দা, বমিভাব, মাংসপেশিতে ব্যথা (বিশেষ করে পিঠে) ও মাথাব্যথা। লক্ষণগুলো সাধারণত পাঁচ দিনের মধ্যে সেরে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো উন্নতি হওয়ার একদিনের মধ্যে পুনরায় জ্বর হতে পারে, পেটব্যথা শুরু হয় ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জন্ডিস হতে পারে ও শরীর হলুদ হয়ে যায়। এজন্য এই রোগের নাম পীতজ্বর রাখা হয়েছে।



১৭৯৩ সালে এই রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছিলো। ফিলাডেলফিয়ায়  ১০,০০০ মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলো। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ এমন  কি রাষ্ট্রপতিও এই রোগের ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

 

পোলিও

পেলিও রোগের আসল নাম হলেও আমরা পলিও হিসেবে চিনি। এটি এমন একটি রোগ যা স্নায়ুতন্ত্র এবং মেরুদণ্ডকে প্রভাবিত করে। এ রোগ এখন খুব বেশি একটা দেখা যায় না। ১৯১৬ সালে পলিও রোগ প্রথম মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সে বছর নিউইয়র্কে ৯ হাজার মানুষ পলিওতে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ৬ হাজার মানুষই মৃত্যুবরণ করে! চিকিৎসাবিজ্ঞান তখন যথেষ্টই উন্নত ছিলো। বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে এর প্রভাবে। 



এই মহামারীতে মৃত্যুর হার আগের যেকোনো মহামারীর চেয়ে বেশি ছিলো!  নিউইয়র্ক শহর থেকে ক্রমে পলিওর প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৫০ সালে জোনাস সাল্ক পোলিও টিকা আবিষ্কার করলে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ কমে যায়।

 

সুত্র- দ্য হিস্টোরি

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ষাট বছর বয়সে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেয়া অ্যানি এডসন টেলর

কেমন ছিল ময়ূর সিংহাসন?