রেমিট্যান্স বন্ধের ডাক: মনে ভয় কিন্তু কেন?

 

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ তিনটি। রপ্তানি পণ্য দ্বিতীয় প্রবাসী আয় ও বিদেশি সাহায্য। প্রবাসী আয়কে আমরা শখ করে বলি রেমিট্যান্স। শোনতেও ভালো লাগে। এটি নিয়ে জাতিসংঘ প্রতি বছর ১৬ জুন পালন করে আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস। বাংলাদেশ সরকারও দিবসটি ঘটা করে পালন করে। বিশ্বজুড়ে ২০০ মিলিয়ন প্রবাসী রয়েছে। এমন একটি প্রতিবেদন গত বছর ২৩ জুন বিবিসি বাংলা প্রকাশ করে। ২০০ মিলিয়ন প্রবাসীর রেমিট্যান্স ভোগ করে ৮০০ মিলিয়ন মানুষ। যারা পরিবার পরিজন।  

রেমিট্যান্স নিয়ে যদি সংজ্ঞা দিতে হয় তাহলে সহজ করে বললে- প্রবাসী তার আয় করা অর্থ যখন তার পরিবারের সহায়তার জন্য দেশে পাঠায় সেটাকে রেমিট্যান্স বলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটাকে বলা হয় ‘লাইফলাইন’। বিশ্বে রেমিট্যান্সের হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান কতো? এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। আমাদের অর্থনীতি রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল কতোটুকু? প্রশ্নের উত্তরে পরে আসি। পুরো বিশ্বের জিডিপিতে ৯.৪% অবদান রাখে প্রবাসী আয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইএমওর হিসেবে বিশ্ব জনসংখ্যার ৩.৪% অভিবাসী। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। উপরের প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় বিশ্বব্যাংকের হিসেবে রেমিট্যান্স উপার্জনে বিশ্বে ৮ম অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা বড় উৎস হল রেমিট্যান্স। প্রবাসী আয় থেকে যোগ হয় দেশের মোট জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে দুই হাজার ১৬১ কোটি ডলারের প্রবাস আয় এসেছিল। আর গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাস আয় এসেছে দুই হাজার ৩৯১ কোটি ডলার।

এবার শিরোনামের ইস্যুতে আসি। চলতি জুলাই মাসে রেমিট্যান্সে পতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ছয় দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় আট কোটি ডলার। জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে আট কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। ধাক্কা লেগেছে রেমিট্যান্সের পালে। আশঙ্কা ধাক্কাটা আরও আসবে। সরকার বড় দুশ্চিন্তায় আছেন! ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকের মাথায় এই দুশ্চিন্তার বোঝা। তিনি তাঁর বক্তব্যে,প্রেস ব্রিফিং ও ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই রেমিট্যান্স নিয়ে বারবার কথা বলছেন। পত্রিকায় এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসের প্রথম ভাগে এক দিনে যে পরিমাণ প্রবাস আয় এসেছিল, সর্বশেষ গত ছয় দিনে এসেছে তার সমপরিমাণ। এমন ডেটা সরকারের মনে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি করতেই পারে। অর্থনীতির জন্য এই অংক আসলেই হতাশার ও আতঙ্কের। যারা অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন তাঁরা বিপদ আঁচ করতে পেরেছেন। সরকারের মন্ত্রী কেন বারবার ব্রিফ করছেন?

১৯ থেকে ২৪ জুলাই ছয় দিনে দেশে প্রবাস আয় এসেছে সাত কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। অথচ চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রবাস আয় এসেছিল সাত কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর জুন মাসে গড়ে দৈনিক প্রবাস আয়ের পরিমাণ ছিল আট কোটি ৪৬ লাখ ডলার।সেই হিসেবে জুলাইয়ের এই ছয় দিনে প্রবাস আয়ের পালে উল্টো হাওয়া লেগেছে। এই হিসাবগুলো সরকারের চেয়ারা বসা মন্ত্রীরা মেলাতে পারছেন না।

কোটা আন্দোলনের জেরে রেমিট্যান্সে ধাক্কা লেগেছে। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। জুনায়েদ পলক দু’ ধরনের বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। প্রথমবার বলেছেন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার তিনি প্রেস ব্রিফিং করে জানান ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি, বন্ধ হয়ে যায়! দেশে সংঘটিত সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও এক ধরনের উত্তেজনা রয়েছে। কোটা বিরোধী আন্দোলন ইস্যু এখানে প্রধান কারণ ও একমাত্র কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কোটা আন্দোলনের ক্ষয়-ক্ষতি বা জয়-পরাজয় নিয়ে আলোচনা করা ইচ্ছে এখানে নেই। এনিয়ে আমি অন্য একটি আর্টিকেল লিখেছি অন্য একটি পত্রিকায়। ‘ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ‘ এই শিরোনামে। সার্চ করে গুগলে দেখতে পারেন।

মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকার কয়েকটি দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেন। এর মধ্যে কোনো কোনো সমাবেশ থেকে রেমিট্যান্স ‘শাটডাউনের’ ঘোষণাও এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপক সাড়া জুগিয়েছে। বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার ও প্রচারপত্র ভাসছে ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে। বাংলাদেশে যদিও ফেসবুক বন্ধ রাখা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। জানা যায় বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে যদি কেউ বিদেশ থেকে প্রবাস আয় পাঠিয়ে থাকেন, ব্যাংকগুলো তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিতরণ করতে বাধ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবাস আয় প্রেরণকারী রেমিট্যান্স হাউসগুলো যদি এ আয় ধরে রাখে, তাতে তা দেশে আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। রেমিট্যান্স হাউসগুলো আয় ধরে রাখেনি। মূলত প্রবাসীরা আয় পাঠাচ্ছেন না। তাঁরা বিকল্প পথে অর্থ প্রেরণ করছেন।

২০২৩ সালের ১ থেকে ১৮ জুলাই প্রবাস আয় এসেছিল ১২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার এমন তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ১ থেকে ১৮ জুলাই দেশে বৈধ পথে প্রবাস আয় এসেছে ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। ফলে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনে প্রবাস আয়ে বড় উল্লম্ফন শুরু হয়েছিল। চলতি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে সাত কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রবাস আয় দেশে এসেছিল। গত ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ মাসের প্রথম ১৮ দিনে এসেছিল প্রতিদিন গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। দেশে প্রবাসী আয় আসা গত এক সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মাসের প্রথম ভাগে এক দিনের যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, সর্বশেষ গত ছয় দিনে এসেছে তার সমপরিমাণ।

প্রবাসীদের পক্ষ থেকে প্রবাসী আয় বন্ধের আহ্বানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। এনিয়ে সামাজিক মাধ্যমে জোর প্রচারণা চলছে। প্রবাসীদের একটি গ্রুপ ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে ও সরকার পতনের দাবিতে অর্থ না পাঠানোর অঙ্গীকার করে অন্যদেরকেও নিরুৎসাহিত করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে ফ্যামিলি থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। এক টাকাও ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠাবো না এমন স্ট্যাটাস দেখা যায়। আমাদের টাকা দিয়ে বুলেট কিনে ওই বুলেট আমার ভাইদের বুকে মারা হয়। আমার ভাইদের হত্যার বিচার না হলে একটা টাকাও ব্যাংকে যাবে না। আমার সাথে কে কে একমত? এমন একটি স্ট্যাটাস দিয়ে খবর ছেপেছে একটি জাতীয় দৈনিক। বিদেশের মাটিতে বসে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। রেমিট্যান্স বন্ধ করে স্বৈরাচার হটাবার আন্দোলনের এমন সুযোগ আর পাব না। সো এক কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধার সাথে আমিও একজন। এমন শপথ বাক্য ফেসবুকে ঘুরছে। কেউ কেউ টুইট করছেন অল্প শব্দে।

দেশে দেশে রেমিট্যান্স শাটডাউনের আহ্বান প্রবাসী আয়ে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা এমন শিরোনাম করেছে দেশের একটি অন্যতম বাণিজ্যিক পত্রিকা। দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে তাই প্রভাব পড়েছে। পত্রিকাটি আশঙ্কা করছে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে। হিসাব পাওয়া যাবে আগস্ট মাসে। জুলাইয়ে আসা রেমিট্যান্স হতে পারে চলতি বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর এই ধারা টানা তিন মাস চলতে থাকলে রিজার্ভের অবস্থা কেমন হবে অনুমেয়।

ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপে বাংলাদেশীরা বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেছে। ফ্রান্স প্রবাসীদের আপাতত দেশে সরাসরি রেমিট্যান্স না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জরুরি প্রয়োজন হলে অন্য কোনো পন্থায় পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন অনেকেই এমন খবর ছাপে দেশের প্রিন্ট মিডিয়াগুলো। এটি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদ। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ১৮ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ সেবাটি ব্যবহার করে কেউ রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি।

প্রবাসীরা বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠান তার বিপরীতে দেশের কোনো ব্যয় নেই। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পুরোটাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের বিপরীতে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশের রফতানি আয় ছিল ৩ হাজার ৭৩৪ কোটি বা ৩৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।

তিন বছর দেশে ডলারের সংকট তীব্র। রেমিট্যান্সই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রপ্তানি ব্যয় থেকে আমদানি ব্যয় মিটাতে গিয়ে হিসাব সমান সমান। দেশে হুন্ডির বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিকে অগ্রাধিকার দিলে অর্থনৈতিক সংকট আরো ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাবে। এই ভয় মনে ধরেছে সরকারের মন্ত্রীদের মনে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ষাট বছর বয়সে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেয়া অ্যানি এডসন টেলর

কেমন ছিল ময়ূর সিংহাসন?

মহামারী প্লেগ, পলিও আর ভয়ানক পীত জ্বরের কথা