উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেলাতে শেখ হাসিনা ফেল করেছেন!

 

ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নাম পাঠকরা হয়তো শুনেছেন বা চিনেন। তাঁকে চেনারই কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালা। লেখকও বটে। যুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন। কেমন টাইপের লেখক তা বিশ্লেষণ না-ই করি। গেরিলা যোদ্ধা। ঢাকার মাটিতে যুদ্ধ করেছেন বলে দাবি করেন। একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে শিশুদের নিয়ে আওয়ামী শাসন ক্ষমতার প্রথম পিরিয়ডে। যাই হোক এবার স্ট্যাটাসের বিষয়ে আসি, তাঁর মেয়ে এশা ইউসুফ। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৮ জুলাই সম্ভবত তথা নেট শাটডাউনের আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যার মূল ভাষ্য-পুরো দেশ বিভাজন দুই ভাগে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে আজকে হাসির পাত্রে পরিণত করা হয়েছে। আমি খুব ভালোভাবে মনে রাখবো। আমি গর্বিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান,আমার উপর আঘাতকে আমি মনে রাখবো। আমি মা হবো, আমি চাই না আমার সন্তান মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে পরিচিতি পাক। কারণ মানুষ বা প্রজন্ম তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা নাতি বলে গালি দেবে। সম্মান প্রদর্শন এখন মুক্তিযোদ্ধা শব্দে নেই। মুক্তিযোদ্ধা নামে অন্যায়কে জায়েজ ও বৈধতা দেওয়া হচ্ছে এখন।



গত আর্টিকেলে ছাত্রদের আন্দোলন ও রক্তক্ষয় নিয়ে লিখেছিলাম। শহিদ আবু সাইদের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কথা বলেছিলাম। গরীব পরিবারের সন্তান। অত্যান্ত গরীব। ভিডিওতে তাঁর বসতঘর দেখলে অনুমেয়। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পরিবারকে ২৬ জুলাই ৭ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। অন্যান্য দাতারা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক জোগান দিচ্ছে। তবুও সন্তান হারানোর ব্যথা লাঘব হবে না।    

শহিদ আবু সাইদের বৃদ্ধ পিতা-মাতার পা ছুঁয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমা চাইলে হয়তো তাঁরা ক্ষমা করেও দিতে পারতেন। পরিস্থিতি হয়তো ভিন্নদিকে মোড় নিতো না। এমন মন্তব্য শোনা যায় চায়ের দোকান কিংবা হাট-বাজারে। যারা সময় নিয়ে বাজার করেন বা অলস সময় চায়ের দোকানে সময় কাটান তাঁরা রাজনীতির পালস ভালভাবে জানেন। শেখ হাসিনা একজনেরও নিহতের বাসায়  যাননি, কারও জানাযাতে যাননি। হাসপাতালে গিয়েছেন পরিস্থিতি অনুকূলে আসার পর। পলক ছবি তাঁর ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ফ্যাক্টচেক বলছে ছবিগুলো তিন বছর আগের! যাইহোক, অন্তত রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ রাতুলের বাসায় যেতে পারতেন। তিনি গেছেন মেট্রোরেল ও বিটিভি ভবন পরিদর্শন করতে। সেখানে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শেখ হাসিনা। সেসব ছবি আমরা দেখছি। ছবি দেখে মনের অবস্থা কেমন যাদের সন্তান নিহত হয়েছে সেটা অনুমেয়। প্রশ্ন জাগে তাহলে তিনি কি নার্ভের পরীক্ষা নিচ্ছেন? এমন পরীক্ষা আগেও কয়েকবার নিয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন দেশের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। রাষ্ট্রের ক্ষয়-ক্ষতি পরিমাপ করতে তিনি ক্লান্ত। উন্নয়নের দাম বেশি তবে রাষ্ট্রের নাগরিকের মূল্য ছেঁড়া পচা এক টাকারও মতো না। 

অধ্যাপক আলী রিয়াজ ভয়েস অব আমেরিকাকে সাক্ষাতকারে বলেছেন মানুষের জিবনের চেয়ে বড় মূল্যবান সম্পদ কোনটা? যারা এই সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছেন বা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন,তাঁদের কাছে অনুরোধ বাড়ি যান। আপনার সন্তানের দিকে তাকান। প্রশ্ন করুন এর থেকে মূল্যবান আর কী আছে? যদি উত্তর ভিন্ন কিছু হয় তবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েন বা টকশোতে গরম বক্তব্য প্রদান করুন।

আমার পৈতৃক ভিটা বা জন্মস্থানের স্থানীয় চেয়ারম্যান ক্ষমতাসীন দলের। তাঁর কাছে আন্দোলনকারী ও ইন্ধনদাতাদের লিস্ট চাইলো মামলার জন্য। দশম শ্রেণির মাদ্রাসা পড়ুয়া এক পরিচিত শিক্ষার্থীকে তিনি রাস্তায় নাম ও পিতার নাম জানতে চাইলো, পরে দেখা গেল তাঁর বিরুদ্ধে মামলা। এবার তিনি নৌকার টিকিট নিয়ে চেয়ারম্যান হতে পারেননি। রাজনৈতিক কলহে সাবেক সাংসদ ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন তাঁকে টিকিট এনে দেননি। সারা দেশে গণহারে মামলা হচ্ছে। অজ্ঞাতনামা মামলায় আসামীরা অজ্ঞাত। মামলার সংখ্যা ও আসামীর সঠিক অংক সারাদেশে কতো জানা নাই। বরিশালের মেয়র রামদা নিয়ে রাস্তায় নামেন এমন ছবি প্রকাশ পায়।

গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর বন্দুক নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে। তাঁর বিশাল মোটরসাইকেল বাহিনী নিয়ে। কিন্তু টিকতে পারেননি। মোটরসাইকেল বহর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এক সহকর্মীকে মেরে গাছে লটকিয়ে রাখা হয়। আর জাহাঙ্গীরের অবস্থা গুরুতর। জানা যায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। এই দায় কে নেবে? তিনি তো গুলি চালাতে গিয়েছিলেন।

যে রাস্তায় ছাত্রদের রক্তের দাগ দগদগে লাল হয়ে আছে এখনও শুকায়নি সেই রাস্তা দিয়েই শেখ হাসিনা বিটিভি ও মেট্রোরেল দেখতে গেছেন। রক্তের উপর দিয়ে রাষ্ট্রের টাকায় তাঁর জন্য বরাদ্দ গাড়ির চাকা লেপটে গেছে। তিনি সাধারণ জনগণের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। সে চাচ্ছে আনাচার,অপশাসন ও কুশাসন মানুষ মেনে নিক। তাঁকে সহ্য করুক। বাধ্য করা হচ্ছে মানুষকে। তাঁকে সহ্য করতেই হবে।

আগুন জ্বলেছে সারা দেশে, সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। রাজধানী বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী। আবাবিল পাখির মতো বিক্ষুব্ধ জনতা ময়দানে নেমে এসেছে। আমি এই আম জনতাকে আবাবিল পাখির মতো মনে করি। নবী মুহাম্মদ সা. জন্মের ৫৫ দিন আগে পবিত্র কাবা ধ্বংস করতে এসে আবরাহাকে আল্লাহ আবাবিল পাখি দিয়ে ধ্বংস করেন। আর আবাবিল পাখির সংখ্যা ছিল অগণিত। ষোল বছর উন্নয়ন দেখিয়ে অগণতান্ত্রিক শাসনকে শেখ হাসিনা বৈধ করেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন দেশের উন্নয়নের জন্য তাকেই ক্ষমতায় থাকা দরকার। মজার বিষয় হচ্ছে- তাঁর উন্নয়নকে ছাত্রজনতা বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছে। প্রাণ ভোমরায় আঘাত করেছেন বিক্ষুব্ধ মানুষ। তাই তিনি আবু সাইদের বাসায় যাননি। সাইদের পিতার পা ধরে ক্ষমা চাননি। উন্নয়নকে খেয়ে ফেলায় তিনি ক্রোধান্বিত। তাঁর ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে জ্বলে অবস্থা। কারণ ফেরি করার মতো আর কিছু বাকি নাই। বিক্রির মাল দুটি ছিল। একটি মুক্তিযুদ্ধ আরেকটি উন্নয়ন। তাঁর আঁতে ঘা লেগেছে তাই তিনি উন্নয়ন ধ্বংস দেখতে রক্তের উপর দিয়ে গাড়ির চাকা মাড়িয়ে গেছেন।



তিনটি মানুষের কথার জন্য ছাত্র আন্দোলন ও এতো রক্তপাত। এক. শেখ হাসিনা। যখন তিনি রাগ নিয়ে বললেন মুক্তিযোদ্ধার নাতীরা চাকরি পাবে না তবে কি সব রাজাকারের বাচ্চা নাতীপুতিরা পাবে? তিনি আন্দোলনরত সকল শিক্ষার্থীদের রাজাকারের সন্তান বলে অভিহিত করেন। দুই. ওবায়েদুল কাদের বলেছিলেন-যারা নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দেয় ছাত্রলীগ তাঁদের শিক্ষা দেবে। ছাত্রলীগকে তিনি লেলিয়ে দিয়েছেন। তিন. ছাত্রলীগ নিজেই এই ঘটনার জন্য দায়ী। পরবর্তী ঘটনা সবাই দেখেছেন ছাত্রলীগ হলে গিয়ে নির্মম ঘটনার জন্ম দিলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভিসির বাসভবনের ভেতর ছাত্রীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। তাঁরা লাইভ করে বাঁচার আকুতি জানান। ছাত্ররা একহয়ে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়া করে। সরকার এসব বিশ্বাস করতে চায় না। মানুষ কেন মেট্রোরেলে আগুন দেয়? কীসের ক্ষোভে রায়েরবাগে পুলিশ মেরে ফুটওভার ব্রিজে লটকিয়ে রাখে? মানুষ কেন স্থাপনায় আঘাত করেছে? সব মিলিয়ে উত্তর একটাই মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ করার আর জায়গা ছিল না। এখনও শত শত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি। আহতদের সংখ্যা বেশি। কয়েক হাজার!   



প্রাণ ভোমরায় আঘাত আসায় শেখ হাসিনা টালমাটাল হারিয়ে ফেলেছেন। এমন নাটক আমরা আরও দেখবো। সময়টা কেমন নিবেন তিনি তা বলা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত এসেছে। বঙ্গবন্ধু চেতনায়ও ধাক্কা লেগেছে। রাষ্ট্রের টাকায় টিভি ও পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবরণে তাঁর অবৈধ শাসনকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা বৃথা গেছে। বিফল হয়েছে পাঠ্য বই দিয়ে গেলানো শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শ। উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনে যাত্রা ফেল হয়েছে শেখ হাসিনার। তাঁর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের মগজধোলাই কাজে আসেনি। এটা প্রমাণিত শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের ঝাণ্ডা বহনের জন্য হাতে গণনা করা যায় এমন কিছু ছাড়া আর পাশে কেউ নাই। তরুণ প্রজন্ম নাই। সব বৃথা গেল!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ষাট বছর বয়সে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেয়া অ্যানি এডসন টেলর

কেমন ছিল ময়ূর সিংহাসন?

মহামারী প্লেগ, পলিও আর ভয়ানক পীত জ্বরের কথা