পেশা যখন জলদস্যুতা
আফ্রিকার একটি দেশ সোমালিয়া, হর্ন অব আফ্রিকা নামে অধিক পরিচিত। আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড নামে এক সময়ে
পরিচিত ছিল এই দেশটি। কিন্তু আজ দেশটি বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভীষিকা এই কারণে যে, জলদস্যুতায় তারা বেশ এগিয়ে। কোনো এক সময় এই রাষ্ট্রটি
বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে অধিক পরিচিত
ছিল পৃথিবীর বুকে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, জলদস্যুতা এখন তাদের শিল্পে পরিণত হয়েছে। অনেক ধনী দেশ এ খাতে
বিনিয়োগ করছে!
ডিঙ্গি নৌকায় মাছ ধরা গরীব
জেলেরা এখন বিশাল ধন ভাণ্ডারের
মালিকবনে গেছে।
আরব সাগর ও লোহিত সাগরের ঠিক মাঝামাঝি এলাকায় আফ্রিকায় দেশটির অবস্থান। সিংহের
মতো বাঁকা সেটি। দেশটির
নাম সোমালিয়া। দেশটির মানচিত্র দেখলে সিংহের মতো হওয়ার কারণে সোমালিয়াকে
হর্ন অব আফ্রিকা বলা হয়। বিগত
শতাব্দীর ৯০ দশকের শুরুতে সোমালিয়ার সামরিক স্বৈর শাসক মুহাম্মদ সাইদ বারির সরকারের
পতনের পর দেশজুড়ে ভয়ানক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিনত হওয়ার কারণে পরবর্তী দশকে সোমালিয়া
উপকুলে আধুনিক জলদস্যুর জন্ম নেয়। সোমালিয়া
সমুদ্র উপকুল ভাগে জলদস্যুতার ঘটনা বিশ্ব বাণিজ্য ও এর নিরাপত্তায় জন্য ব্যপক হুমকি
হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘ
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপে সত্ত্বেও সোমালিয়ায় জলদস্যুতা থেমে থাকেনি। এখন আমরা জানবো কেনো এবং কীভাবে শুরু হয় এই দস্যুতা?
১৬৫০-১৭৩০ সময়টা ছিল জলদস্যুতার স্বর্ণ যুগ। সে সময় ব্রিটিশরা সম্রাজ্য বিস্তার করার জন্য সমুদ্র পথে
বহু অভিযান পরিচালনা করে। এসব
অভিযানে ব্যবহৃত জাহাজের কর্মীদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানো হতো। বিনিময়ে সামান্য মজুরীও কপালে জুটত না। আর যা জুটত তা যথার্থও ছিল না। শ্রমিকদের শুধু
খাবারই ছিল সাধারণ মজুরি। যদি মনে
হতো যে শ্রমিকরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, তাহলে কপালে
জুটত কঠিন
শাস্তি। শাস্তির
মাত্রা মাঝে মাঝে এমন বেশি হতো যাতে তাদের জীবনও চলে যেতো।
সামান্য ভুলে চাবুকের আঘাত ছিল নিত্য সঙ্গী। অপরাধ বেশি মনে হলে জাহাজ থেকে পানিতে ফেলে দিতো। দীর্ঘ দিনের এই অন্যায় কিছু নাবিকদের মনে বেশ ক্ষোভের সৃষ্টি
করে। তারা
এই অন্যায় মানতে পারেনি, ক্ষোভে তারা দস্যুতায় পরিনত হয়।
১৯৯১ সাল সোমালিয়ার জন্য চরম দুঃসংবাদ। দেশের সরকার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। তখন
সমুদ্র সীমায় ইউরোপীয় বহু দেশের জাহাজ ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। তারা সোমালিয়া অঞ্চলে বিরাট বিরাট ব্যরল ফেলতে থাকে। ব্যারল বলতে বিশাল বিশাল ট্যাঙ্ককে বুঝানো হয়। উপকুলে ভেসে আসা এই ব্যরল ছিল নানান তেজস্ক্রিয় পদার্থে পরিপূর্ণ। বছর দু’এক পর এর প্রভাব বুঝতে পারে উপকূলীয় বাসিন্দারা, নানান
অদ্ভুত রোগ দেখা দেয় এখানে। একসময়ে
গর্ভবতী নারীরা বিকালঙ্গ শিশু জন্ম দিতে থাকে।
২০০৫ সালে সুনামির পর হাজার হাজার পরিত্যক্ত ব্যরেল সোমালিয়ার
উপকুলে ভেসে আসে যা ছিল ফুটো করা। হসপিটালের
বর্জ্য, ইউরোপীয় কারখানার বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে ভর্তি ছিল এ ব্যারলগুলো।
ইউরোপীয় প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের
মাধ্যমে সস্তায় তারা এসব বর্জ্য সোমালিয়ায় সমুদ্র সীমায় খালাস করে, পারমানবিক উপাদান
আর সিসা ও মার্কারের মতো ক্ষতিকর পদার্থ সোমালিয়া পানিতে মিশে যায়। এরপর সোমালিয়ানরা নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হতে থাকে।
ইউরোপীয় সরকার এ নিয়ে কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়নি। একই সময় কিছু ইউরোপীয় সমুদ্র জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র সম্পদ
লুট করতে থাকে। সমুদ্র সম্পদ হিসেবে
মাছ ছিল প্রধান সম্পদ। এতোই
পরিমানে মাছ আহরণ করে সহসাই
সোমালিয়াতে মাছের
ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসে! কয়েক বছরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মাছের দাম নিয়ে যায়।
জেলেরা দিন দিন মাছ হারিয়ে ফেলতে থাকে। সে সময়ে কিছু সাহসী জেলে স্পিড বোট নিয়ে জাহাজগুলিকে তাড়া করে। সমুদ্রে আসা জাহাজে তারা ভ্যাট বসাতে চেয়েছিল,কিন্তু এতে ইউরোপীয়রা রাজি হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে বর্জ্যের কয়েকটি জাহাজ তারা সাহস করে আটকিয়ে দেয়, এতে বেড়ে যায় তাদের সাহস। একসময়ে এরা ভাবতে
থাকে জাহাজ না তাড়িয়ে ট্যাক্স বা ছিনতাই করা সহজ, এমনকি মুক্তিপণও
আদায় করা যায়। যেই চিন্তা সেই কাজ। একবার
কয়েকজন মিলে তৈরি করে বাহিনী। শুরু
করে অপারেশন, সাফল্য আসে এতে।
সমুদ্র সমন্ধে ভালো জ্ঞান থাকায় এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। স্থানীয় কিছু লোকজন তাদের বাহবা দেয় ও নিজেদের সম্পৃক্ত করে এই পেশায়। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল হুমকির মুখে পড়ে যায়।
বাংলাদেশও ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এমভি মণি নামে ২৬ জন নাবিকসহ জাহাজটিকে ভারতীয় জলসীমা থাকে জিম্মি
করে দস্যুরা। ৬৩ কোটি টাকা মুক্তিপণ
চায় জলদস্যুরা। প্রায় তিন মাস পর
টাকা হস্তান্তরের পর মুক্তি পান নাবিকরা। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই জলদস্যুরা দীর্ঘ মেয়াদে ছিনতাই করা
জাহাজ ও জিম্মিদের মুক্তি দেয়। কোনো কোনো সময় দেখা
যায় দু’ বছরেরও অধিক সময় ধরে জিম্মিদের তারা লালন পালন করে থাকেন।
মুক্তিপণের লেনদেন হয় সরাসরি ভাবেই, হেলিকপ্টারের মাধ্যমে টাকা ফেলতে হয় জাহাজে
তারপর মুক্তি মিলে জিম্মিদের। জলদস্যুরা স্যাটেলাইট
ফোন ব্যবহার করে থাকে।
সুত্রঃ টাইম ডট কম, সিএনআরএস
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন