ইসলামে বউ শাশুড়ির পারিবারিক সম্পর্ক

 

তোমরা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে নিজের জন্য অন্যের মেয়েকে হালাল করেছ সাবধান তাদের  ওপর জুলুম করো না, ইনসাফ করো বিদায় হজে আল্লাহর রাসুল সা. তার ভাষণে এই কথা বলেছিলেন স্বামীদের উদ্দেশ্যে ইসলাম পারিবারিক জীবনে প্রতিটি ধাপে ইনসাফ বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন জাররা পরিমাণ বিষয়ের হিসাব নিকাশের কথা বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে সুতরাং পারিবারিক জীবনের অধ্যায়টি উপেক্ষা করা যায় না

পিতা-মাতাকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে পুত্রের সংসার আমাদের  দেশে টিকে আছে ভালো ভাবেই যৌথ পরিবারে ঝামেলা নেই এমন নয় সংসার জীবনে পরিবারের কর্তাদের অনেক সমস্যা পোহাতে হয় মা ও স্ত্রীর মন রক্ষা করতে একজন পুরুষের দরকার ধৈর্য ও ইনসাফ কোনো প্রকার জুলুম বা পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না মা ও বউ উভয়ের প্রতি সদয় হবার নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম

শাশুড়ির ব্যবহার বউয়ের জন্য স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে বউকে আঘাত করে কথা বলতে পারেন বউয়ের নেওয়া সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করতে পারেন এ ধরনের সমস্যা এড়াতে শাশুড়ির সঙ্গে এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করা উচিৎ শাশুড়িকে ভাবা উচিৎ আমিও একদিন বউ ছিলাম আর আমার মেয়েটাও অন্য ঘরের বউ এছাড়া ইসলাম অন্যের প্রতি সুন্দর আচরণের তাগিদ দিয়েছে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন- “তার কথার চাইতে আর  কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে এবং ঘোষণা করে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত“ (হামিম সিজদা-৩৩) হযরত জাবির ইবনে  আবদুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন, যতবার আমি রাসূলে কারিম সা.-এর সাথে সাক্ষাত করেছি, প্রত্যেকবারই তিনি হাসিমুখে সম্ভাষণ করেছেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার কথা শুনেছেন



মধুর চরিত্রের অধিকারী ও মিষ্টভাষীদের জন্য জান্নাতের সুখবর রয়েছে পবিত্র হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যে কথাটি প্রকৃতই মিথ্যা এবং অসঙ্গত, যে ব্যক্তি তা বলা এবং আলোচনা করা পরিত্যাগ করে- তার জন্য জান্নাতের কিনারায় স্থাপনা নির্মিত হয় যে ব্যক্তি সঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া-বিবাদ পরিত্যাগ করে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যে বাসস্থান নির্মিত হয় যে ব্যক্তি বাক সংযম, মিষ্টভাষণ এবং সত্য কথা প্রভৃতি গুণ দ্বারা নিজের চরিত্র সৌন্দর্যমন্ডিত করে, তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে বাসস্থান নির্মিত হয় ’ – মিশকাত

স্বামীর জীবনে অন্যতম একজন মানুষ তার মা মা তাকে লালনপালন করে বড় করেছেন এত দিন মা ছিলেন তার সব সুতরাং স্বামীর মাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না সংসারে, স্বামীর জীবনে তার গুরুত্ব বুঝতে হবে তাকে বোঝার চেষ্টা করুন তার সঙ্গে পরশ্রীকাতরতা পরিহার করুন    

মানবচরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকারক বিবাদ মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষময় করে তোলে এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ন হওয়াকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করেছে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৪) নবী করিম সা. সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়’ (আবু দাউদ)

শাশুড়ি তার সিদ্ধান্তে অটল বউও তার দিক থেকে অনড় এমন হলে সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকেই যাবে বরং এ ক্ষেত্রে বউ একটু নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন শাশুড়ির চোখরাঙানির মুখেও ধৈর্য ধারণ করুন নরম সুরে কথা বলুন শাশুড়ির সমালোচনা পরিহার করাই ভালো ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহারে মুহূর্তের মধ্যে কারো মন জয় করা যায় আবার এ ভাষা দিয়েই অন্যের হৃদয়ে কম্পন ও রক্তক্ষরণ করা যায় গালাগাল, যাচ্ছেতাই বলে যাওয়া কেবল ধর্মবিরোধীই নয়; আদর্শ ও সুরুচিপূর্ণ ব্যক্তির দৃষ্টিতেও নিন্দনীয়  



মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা অহেতুক কথা থেকে বিরত থাকেন আল্লাহ তাআলা বলেন,‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী, যারা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকেসুরা : মুমিনুন, আয়াত : -) রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘ব্যক্তির জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার অহেতুক কথা ও কাজ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে

ইসলামে বাকসংযমের কথা বলা হয়েছে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণের জন্য তার কাছেই (অদৃশ্য) তত্পর প্রহরী রয়েছে’ (সুরা : ক্বফ, আয়াত : ১৮) কাউকে কটাক্ষ করা, উপহাস করা, কারো দিকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করা এবং মন্দ বিশেষণে কাউকে ভূষিত করা ইসলামে খুবই গর্হিত অপরাধ

হালকা ধরনের কৌতুক, হাস্যরস বউ-শাশুড়ির মধ্যকার সম্পর্ককে আরও সহজ করে তুলতে পারে শাশুড়ি হয়তো বউয়ের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ অভিযোগ করেই চলছেন বউয়ের উচিত এটাকে সহজভাবে নেওয়া হাস্যরস করে অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়া  

শাশুড়ির কাজের স্বীকৃতি দিন পরিবারে তার অবদান, ভালো কাজের প্রশংসা প্রকাশ্যে করুন তাকে জানিয়ে দিন, তার প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতার কমতি নেই তবে মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা পরিহার করা উচিত কারণ, এতে আপনার মনোভাব প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে সুস্পষ্টভাবে মন থেকে পরিমিত প্রশংসা করুন

রাসুলুল্লাহ সা.-ও তার সাহাবিদের প্রশংসা করেছেন ওমর রা.-কে তিনি বলেন, ‘তুমি যে পথে চলো শয়তান কখনো সে পথে চলে না, বরং সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৯৪) ইসলাম অনুগ্রহকারীর কৃতজ্ঞতা আদায়ে উৎসাহিত করেছে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে (যথাযথভাবে) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারে না’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৩৩১)

বউ তার শাশুড়ির প্রতি ভালো কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করবে তদ্রুপ শাশুড়ির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য ব্যক্তিকে ভালো কাজে উৎসাহিত করতে প্রশংসা করা বৈধ রাসুলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, ‘আবদুল্লাহ কতই না উত্তম ব্যক্তি যদি সে তাহাজ্জুদ আদায় করত’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৫৬)

দুজনের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হলে দ্রুত তা ব্যাখ্যা করুন ভয়ে বা লজ্জায় মনের মধ্যে কথা চেপে না রাখাই ভালো শাশুড়ির পাশে গিয়ে বসুন আন্তরিকতা নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির বিষয়টি তাকে গুছিয়ে বলুন ক্ষমা বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় পাওয়া সৃষ্টি জগতের প্রতিটি মানুষ ভুল করে তবে, এরমধ্যে তারাই উত্তম যারা ভুল স্বীকার করে, ভুলের জন্য ক্ষমা চায় এবং দ্বিতীয়বার ভুল না করার প্রতিশ্রুতি দেয় কারো ভুলে তার প্রতি  ক্রোধ দেখানো, রাগ ঝাড়া, জেদ-উত্তেজনা কিংবা উগ্র-কাতর হওয়া ভীষণ নিন্দনীয় এসব মানুষকে ছোট করে আমলনামা থেকে সওয়াব মুছে দেয়

বিপরীতে ক্ষমা মানুষের মান-মর্যাদা বাড়ায় কাউকে ক্ষমা করে একজন সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠতে পারেন অসাধারণ মানুষ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা ভালো কিছু প্রকাশ করো কিংবা গোপন করো অথবা মন্দ ক্ষমা করে দাও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, ক্ষমতাবান ’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৪৯)



তর্কে তর্ক বাড়ে দুজনে মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে পাল্টা জবাব বা তর্ক পরিহার করা শ্রেয় ক্ষুব্ধ হয়ে শাশুড়ি তার কথা চালিয়ে গেলেও আপনি থেমে যান পাল্টা জবাব দিলে শাশুড়ি আরও কথা বলার সুযোগ পাবেন এতে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে শান্ত হলে শাশুড়িকে সব বুঝিয়ে বলুন মহানবী সা.কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেছেন, তোমরা পরস্পরের বিরোধিতা কোরো না; তাহলে তোমাদের অন্তরগুলো বিভক্ত হয়ে যাবে (মুসলিম, হাদিস : ৮৫৮) বিশেষত মূর্খদের এড়িয়ে চলতে আদেশ দিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, যখন জাহেল ব্যক্তিরা তাদেরকে (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম কোরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যখন তারা কোনো বেহুদা কথা শোনে, তা উপেক্ষা করে যায় বলে, আমাদের কাজের ফল আমরা পাব এবং তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে সালাম তোমাদের, আমরা জাহেলদের সঙ্গে কথা বলি না’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৫)

সবাইকে নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অহেতুক বিরুদ্ধাচরণ থেকে বেঁচে থাকার সুযোগ দান করুন সেই সত্য-সঠিক বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ষাট বছর বয়সে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেয়া অ্যানি এডসন টেলর

কেমন ছিল ময়ূর সিংহাসন?

মহামারী প্লেগ, পলিও আর ভয়ানক পীত জ্বরের কথা