পুরান ঢাকার বাহারি খাবার

 

ঝুনুর বিরিয়ানি



১৯৮০ সালের দিকে নূর মোহাম্মদ নারিন্দার মোড়ে একটি বিরিয়ানির দোকান খোলেন। আদরের কন্যা ঝুনুর নামেই দোকানটির নাম রাখেন। মুরগি প্রধান এই বিরিয়ানি ভিন্ন স্বাদ হওয়ার কারণে এলাকায় ঝুনুর পোলাও নামে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৮ তে নূর মোহাম্মদ মারা গেলে তার ভাই ইসার উদ্দিন ও পরে তার ছেলে মোঃ স্বপন ও মোঃ শামিম দোকানটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। বিকাল বেলায় এই দোকানটি খোলা হয় আর রাত নয়টায় অবধি তাদের পোলাও বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আগের মানের সাথে টিকে না থাকতে পারলেও সময় বিচারে ঘরটি এখন টিকে আছে।

হাজীর বিরিয়ানি

হাজীর বিরিয়ানির নাম শুনেনি এমন মানুষ পুরান ঢাকায় খোঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। পুরান ঢাকা এখন যে কয়েকটি কারণে নাম ধরে রেখেছে তার মধ্যে হাজীর বিরিয়ানি অন্যতম। বেশ পুরনো এ ইতিহাস। যুগের পর যুগ সুনাম ধরে রেখেছে এই রসনাময় খাবার।      

১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন ঢাকার প্রচলিত বিরিয়ানি থেকে একটু ভিন্ন ও বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করেন।  ঢাকাবাসীর জন্য ভোজনে ব্র্যান্ড তৈরি করেন। যা এক কথায় হাজীর বিরিয়ানি নামে পরিচিত। এক কথায় বলতে গেলে হাজীর বিরিয়ানি একটা ইতিহাসের   গল্প। নাজিরা বাজারে হাজীর দোকানে এক সময়ে সকালে দুই ডেক বিকালে দুই ডেকের বেশি বিরিয়ানি রান্না হতো না। বিরিয়ানির বিশেষত্ব হচ্ছে তেল ঘি নয় সম্পূর্ণটা সরিষার তেলে রান্না করা হয়। এখনো একই পদ্ধতিতে রান্না হয় এই বিরিয়ানি।   

মাংস হিসেবে দেওয়া হয় খাসির মাংস। জানা যায় নিজ হাতে তদারকির মাধ্যমে অনুশাসন মেনে হাজী গোলাম হোসেন এই বিরিয়ানি তৈরি ও পরিবেশন করতেন। সেই সময় ফুল প্লেট খাসির তেহারি বারো আনায় বিক্রি হতো। বর্তমানে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়। ঢাকায় বিরিয়ানির জন্য সকাল বিকাল লাইন দিয়ে কেনা একমাত্র হাজির বিরিয়ানির দোকানেই দেখা যেতো। ঢাকায় অন্যান্য বিরিয়ানির দোকানের নাম ও প্রসারের যুগেও হাজির বিরিয়ানি তার ঐতিহ্য ও অনুশাসন মেনেই ঢাকার নাজিরা বাজারে একটি মাত্র দোকান থেকে ব্যবসা করে আসছেন। তবে দেরিতে হলেও দেশে ও বিদেশে পরবর্তী বংশধররা হাজী নামে দোকানের শাখা বিস্তার করছেন।  



ঘুগনি

পুরান ঢাকা কে ঘিরে আছে নানান ঐতিহ্য। খাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও স্থাপনায় এই নগরীর জুড়ি নেই। সেই মোঘল আমল থেকে খাবারে বেশ খ্যাতি আছে। মোঘল শাসন আমলে দেশে খাবারের মাঝে বড় পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে নতুন খাবারের দিকে। কালের বিবর্তনে বেশ কিছু খাবার বিলুপ্ত হলেও কিছু খাবার আছে এখনও।

পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন খাবার হচ্ছে ঘুগনি। কেউ কেউ এটাকে ঘুমনি বলেও ডাকে। এ খাবারটি এখনও আছে সাড়া শহর জুড়ে। গ্রাম গঞ্জেও এ খাবারটির সন্ধান মিলে। বিশেষ করে স্কুল- কলেজের সামনে ফেরি করে বিক্রি করে থাকেন ফেরিওয়ালারা।

ঘুগনি যা মটর ডালের তৈরি । বিশেষ করে পুরান ঢাকায় এর প্রচলন বেশি। এটি এক ধরণের মুখরোচক খাবার। মটর সিদ্ধ করে নরম মণ্ড করে তৈরি করা হয় এই ঘুগনি। মটর সিদ্ধে ব্যবহার করা হয় লবণ ও সোডা। সস্তা খাবার হিসাবে এর প্রচলন বেশি। রমজানে ইফতারের সময় দেখা যায় পুরান ঢাকায় বাড়িতে বাড়িতে মুড়ির সাথে মাখার জন্য এটি ব্যবহার হয়ে থাকে। নতুন ঢাকায়ও এর প্রভাব রয়েছে।

পথে প্রান্তে ফেরিওয়ালা ঝাল মুড়ির সাথে এটি মিশিয়ে বিক্রি করে থাকেন। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে মেলা, খেলার মাঠে, লোক সমাবেশের অনুষ্ঠানে ফেরি করে ঘুগনি বিক্রি রেওয়াজ বেশ চল দেখা যায়। ঘুগনির সাথে বিভিন্ন চাট মসলা ও শশা ডিম ও পুরির ব্যবহার করে বিক্রি করে থাকেন।

 


শুক্তো

তেঁতো বা তিত জাতীয় খাবার। বাঙালী প্রবাদ আছে, “আগে তেঁতো পরে মিঠা”। খাবারের শুরুতে তেঁতো খাবারের চলটি এখান থেকে এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। খাবারে শুক্তোর ব্যবহার মুখের স্বাদ বদলে রুচিকর এবং ঔষধইগুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। শুক্তো তৈরির প্রধান উপকরণ করল্লা এবং ক্ষেত্র বিশেষে নিম পাতা। সাথে বেগুন, আলু, সজনে, কুমড়ো, কাঁচ কলা, কুমড়া, ডাল ইত্যাদি।

খাবার পরিবেশনে হিন্দু সংস্কৃতিতে সনাতনি প্রথা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে শুক্তো। রন্ধনশৈলী খুবই সাধারণ কিন্তু হিন্দু বাড়িতে গরম কালে দুপুরের খাবারে অতি পরিচিত পদ শুক্তো। কম মসলার সহজ পাচ্য ও রুচি বর্ধক  একটি খাবার।

 

সোনা মিয়ার দই

পুরান ঢাকা খাবারের জন্য বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। বর্তমানে খাবারের জন্য এই নগরী বেশ বিখ্যাত। বিশেষ করে মোঘল শাসন থেকেই খাবারের তালিকায় বেশ পরিবর্তন আসে। কিছু কিছু খাবার কথা মানুষের মুখে মুখে এখনও শোনা যায়। সাদ উর রহমানের লেখা ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি বইয়ে শতকের উপর খাবারের কথা উল্লেখ আছে।

ঐতিহ্য নিয়েও আছে অর্ধশতকের উপর বিষয়, এই বইয়েতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতিও। যা অনেক কিছু আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। 



১৯৪৭ সালে শরীয়তপুরের সোনা মিয়া কাজের অন্বেষণে ভারতের কোলকাতায় মিষ্টির দোকানে কাজ নেন। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে ঢাকার গেণ্ডারিয়া এসে সোনা মিয়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। তৈরি করেন কারখানাও, তার দইয়ের সুনাম দেশ ছড়িয়ে বিদেশেও বেশ নাম ডাক ফেলে দেয়। দেশে বিদেশের নাম করা ব্যক্তিদের আপ্যায়নে সোনা মিয়ার দই এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল। বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে খাঁটি দুধ এনে দই তৈরি করে থাকেন। যা বাজারের অন্যান্য দই থেকে ব্যতিক্রমী বটে। মিষ্টি থেকে তার দইয়ের সুনামই বেশি।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ষাট বছর বয়সে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেয়া অ্যানি এডসন টেলর

কেমন ছিল ময়ূর সিংহাসন?

মহামারী প্লেগ, পলিও আর ভয়ানক পীত জ্বরের কথা