সমাজতন্ত্রের কাল মার্কস তার দর্শনজীবন
প্রুশিয়ার রাইনল্যান্ড প্রদেশের ট্রিভস নামক একটি শহরে কট্টর ইহুদী পরিবারে ১৮১৮ সালে জন্ম নেন এই বিখ্যাত পৃথিবী কাঁপানো মানুষটি। হেইনরিখ ছিলো তার শ্রদ্ধেয় পিতার নাম,মার্কস তার বংশগত ঐতিহ্যের গৌরবন্বিত নাম। হেনরিয়েটা তার মায়ের নাম। প্রিয় মানুষটি ছিলো স্ত্রী,এ্যাণি নামে তাকে ডাকতো কাল মার্কস। পিতার মাতার সাথেই শৈশব কাটে মার্কসের,পিতা ছিলেন একজন আইনজীবি। প্রাথমিক শিক্ষা নেন স্থানীয় গ্রামার স্কুলে। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৮৪১ সালে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। জন্ম প্রুশিয়ায় হলেও পড়াশুনা হয় জার্মানে। প্রাথমিক জীবনে শিক্ষকতার ইচ্ছে থাকলেও রাজনৈতিক চরমপন্থী মতবাদের জন্য তিনি এ সুযোগ হতে ব্যর্থ হন। ১৮৪২ সালে ‘’রেনিশ জিটাং’’ নামক একটি চরমপন্থী জার্মানীর পত্রিকায় সম্পাদকমন্ডলীর অন্যতম সদস্য হিসাবে যোগদান করেন। ভাগ্য এই মানুষটিকে বেশি দিন ভালো থাকতে দেয়নি। পরের বছর এই গণমাধ্যমটি বন্ধ করে দেয়া হয়। চলমান অবস্থা ও তার চরম মতালম্বীতার দায়ে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি প্যারিশে গমণ করেন,সেখানে বন্ধু ও একসহযোগীর সান্যিধ্য লাভ করেন। ১৮৪৪ সালে তার বন্ধু ও একনিষ্ঠ সহযোগী ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের সহচর্য লাভ করেন।
মার্কেসের বন্ধুর পিতা একজন ধনকুবের বস্র ব্যবসায়ী
ছিলেন। ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে তার বয়নকারখানা (weaving factory) ছিলো। এঙ্গেলসের
যাতায়াত ছিলো বাবার কারখানায়,তিনি ইংল্যান্ড শিল্পব্যবস্থা ও শ্রমীকদের জীবন-যাপন সম্পর্কে
বেশ জ্ঞানলাভ করেন। বন্ধুর সাথে নিবীড় সম্পর্ক থাকায় মার্কসও বেশ জ্ঞান লাভ করেন। আর
এ বিষয় থেকে ১৮৪৮ সালে আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য দলিল ‘কম্যুনিস্ট
ম্যানিফেস্টু’ প্রকাশিত হয়।
কিন্তু মার্কের চরমপন্থি মতবাদে ফ্রান্সের
শাসন কর্তৃপক্ষ বেশিদিন নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারেনি। ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টু’ প্রকাশিত
হবার অল্প কিছুকাল পরেই তাকে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করা হয়। ফ্রান্স থেকে তিনি ব্রুসেলসে
যান,কিন্তু ব্রুসেলস থেকেও তিনি বিতাড়িত হন। তিনি পুনরায় জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন করেন,কিন্তু
এই মানুষটি সেখান থেকেও বিতাড়িত হন। তিনি বেশিরভাগই একস্থানে ঠাঁই হতে পারেননি। ‘’তাঁতের
মাকুর মতো’’ছুটাছুটি করতে হয়েছে। অবশেষে সর্ব আদর্শের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ইংল্যান্ডে
গমন করেন এবং বাকি জীবন সেখানেই কাটিয়ে দেন।
লন্ডনে তার জীবন ছিলো দারিদ্র্যপীড়িত। ছেলেমেয়েদের
পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য নিজকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হতো। শীত নিবারণের জন্য শীতবস্র ছিলোনা
বললেই চলে। তবুও এই দুঃখ-কষ্টকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ও লাইব্রেরিতে দীর্ঘক্ষণ
ধরে পড়াশোনা করতেন। স্ত্রী এ্যানি ছিলেন একজন উপযুক্ত সহধর্মিণী। তিনি একটা ভারী অসুখের
পর তার বন্ধুকে জানিয়ে ছিলেন, ‘ভেবোনা যে এ সামান্য অসুখে আমরা ভেঙ্গে পড়বো’। বস্তুত
এ মহিয়সী নারীর প্রেরণা মার্কসকে আজীবন সঞ্জীবিত রাখে এবং তিনি সৃষ্টি করতে সমর্থ হন
দারিদ্র্য ও শোষণমুক্তির পথ নির্দেশিকা।
মার্কেসের রচনাবলীর সংখ্যা অনেক,তবে সেগুলোর
মধ্যে ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ ১৮৪৮ ও ‘ডাস ক্যাপিটালই’১৮৬৭ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তবে
‘ডাস ক্যাপিটালই’ গ্রন্থটি তিনি সমাপ্ত করতে পারেনি। এ গ্রন্থে তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ে
বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। মার্কস শুধু লিখেই আন্দোলন শেষ করেননি,শ্রমিক আন্দোলনে
তিনি নিজেই অংশগ্রহণ করেন। তার জীবনভর পরিশ্রম ও সংগ্রামের পর ১৯১৭ সালে পূর্বতন সোভিয়েত
ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। এটা ছিলো মার্কসবাদের প্রথম প্রায়োগিক রূপ তথা প্রথম
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
কাল মার্কস সমাজতন্ত্রের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন
না। তিনি তার পূর্বসূরি খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবিদের রচনা পাঠ করে তাদের দূরদৃষ্টি ও সীমাবদ্ধতা
সম্পর্কে সচেতন হন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন